বঙ্গবন্ধুর কল্যাণধর্মী উন্নয়ন ভাবনা ও সমকালীন বাংলাদেশ [পর্ব ৩]



ড. আতিউর রহমান

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রথম পর্বের লিংক
দ্বিতীয় পর্বের লিংক

বঙ্গবন্ধু এবং আগামীর বাংলাদেশ
স্বল্প পরিসরের এই আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বঙ্গবন্ধুর সকল ভাবনার মূলে ছিলেন সাধারণ মানুষ। সেই শৈশব থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিনগুলোতেও তিনি কৃষকের কল্যাণ, শ্রমিকের কল্যাণ, সাধারণের মঙ্গল-ভাবনায় ছিলেন সমর্পিতপ্রাণ। প্রশাসক হিসেবেও সর্বক্ষণ তাঁর পক্ষপাতিত্ব ছিল সাধারণের দিকে। তাঁর দেওয়া সংবিধানই এর বড় প্রমাণ। সাধারণ মানুষকে তিনি প্রজাতন্ত্রের মালিক বানাতে চেয়েছেন ওই সংবিধানের মাধ্যমে।

তাঁর শাহাদাৎ বরণের পর স্বদেশ হাঁটতে থাকে অন্ধকার ও অনিশ্চিত এক গন্তব্যের দিকে। দীর্ঘ একুশ বছর ধরে উল্টোপথে হাঁটা সেই বাংলাদেশকে ফের ১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সড়কে তুলে আনেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর গরিব-হিতৈষী কৃষক ও উদ্যোক্তা-বান্ধব উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে ‘অন্ধকার থেকে আলোর পথে’ তুলে আনেন তিনি। ফের ছন্দপতন ২০০১ সালে। আবার মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিরোধী অপশক্তির দাপটে হতাশায় নিমজ্জিত হয় বাংলাদেশ। মাঝখানে দু’বছরের সামরিক হস্তক্ষেপের পর বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ফের ক্ষমতায় আসেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে প্রায় একদশক ধরে এগিয়ে চলেছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ। নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও গত এক দশক ধরে ৬ শতাংশেরও বেশি হারে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঘটছে। গত তিন বছর ধরে তা বেড়েছে ৭ শতাংশেরও বেশি হারে। গত অর্থবছরে বেড়েছে ৭.৬৫ শতাংশ হারে। এ দশকে অবকাঠামো খাতে ব্যাপক হারে সরকারি বিনিয়োগ হয়েছে (জিডিপির ৪.৩% থেকে ১২.২%)। পদ্মা সেতু, এলএনজি টার্মিনাল, মেট্রোরেল, পায়রা বন্দর, রূপপুর আণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র, চারলেনের রাস্তা, ফ্লাইওভারসহ ব্যাপকহারে অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের শক্তিশালী পাটাতন নির্মাণ করেছে সরকার। গত একশো বছরে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষম অবকাঠামো মাত্র দশ বছরে তিনগুণেরও বেশি উৎপাদনসক্ষম করে গড়ে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। আমাদের খাদ্য উৎপাদন বেড়ে স্থিতিশীল পর্যায়ে রয়েছে। গত এক দশকে অতি দারিদ্র্য কমেছে ১৭.৬ শতাংশ থেকে ১২.৯ শতাংশে। আমাদের মাথাপিছু আয় ২০০৮ সালের হিসেব থেকে তিনগুণ বেড়ে ১৭৫২ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আমরা এখন স্বল্পোন্নত দেশের তকমা ঝেড়ে জাতিসংঘ থেকে উন্নয়নশীল দেশের পরিচয়ের ছাড়পত্র পেয়েছি। আমাদের গড় আয়ু এখন ৭২.৫ বছর, যা একজন ভারতীয়’র চেয়ে চার বছর এবং একজন পাকিস্তানীর চেয়ে ছয় বছর বেশি। এক দশকে শিশু মৃত্যুর হার হাজারে ৩৯ থেকে নেমে ২৮ হয়েছে এবং মাতৃ মৃত্যুর হার হাজারে ২.৫৯ থেকে কমে ১.৭৮-এ দাঁড়িয়েছে। মনে রাখা চাই ১৯৭২ সালে ৮ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির আকার এখন দাঁড়িয়েছে ২৮০ বিলিয়ন ডলার। এই দশকে ১৬ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

গ্রামে গঞ্জে মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিংসহ আর্থিক সেবা ব্যাপক হারে পৌঁছে গিয়েছে বলে সহজেই রেমিটেন্স ও অর্থের লেনদেনও বেড়েছে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে পুনর্জাগরণ ঘটেছে। খালি চোখেও গ্রাম-বাংলায় অর্থনীতির দিন বদল দেখা যায়। গ্রাম আর শহরের অর্থনীতিতে সংযোগ বেড়েছে। আট হাজারেরও বেশি অনলাইন রিটেল ব্যবসায়ী প্রতিদিন সামাজিক মধ্যমে ব্যবহার করে শত শত কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। ই-কমার্স, ক্ষুদে ও মাঝাারি উদ্যোগে নারীর অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে। সর্বত্রই অর্থনীতির গতিময়তা চোখে পড়ছে। আর বাংলাদেশের অর্থনীতি যে স্থিতিশীল রয়েছে তা তিনটি আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সিই তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানিয়েছে। সম্ভাব্য রাজনৈতিক ঝুঁকির কথা স্বীকার করেও তারা বলেছেন আগামী দিনের অর্থনীতি স্থিতিশীলই থাকবে। তবে আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনাকে আরো শক্ত হাতে পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছে তারা। তাদের এই পরামর্শের সাথে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরাও একমত। কেননা ব্যাংকিং খাত যে অর্থনীতি হৃৎপিণ্ড। তাই তাকে সবল ও সচল রাখার কোনো বিকল্প নেই। নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের যে নয়া কৌশল বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্ভাবন করেছে তার বাস্তবায়নে নিবেদিত থাকা গেলে এই খাতের ঝুঁঁকি মোকাবেলা সম্ভব। নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর অমর্ত্য সেন, বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ প্রফেসর কৌশিক বসু এবং বর্তমান প্রধান অর্থনীতিবিদ পল রোমার বাংলাদেশের বিস্ময়কর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের প্রশংসা বরাবরই করে যাচ্ছেন। এই সাফল্যের পেছনে মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ আর সব ধরনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকার লড়াকু মন তৈরি করে দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর আপোষহীন নেতৃত্ব। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের পুনর্নিমাণের নেতৃত্বও তিনি দিয়েছেন একইভাবে। তাই দুর্যোগে দুর্বিপাকে ঘুরে দাঁড়াবার এক অসাধারণ সহনশক্তি অর্জনে আমাদের পুরো জাতির বিশ্বব্যাপী সুনাম রয়েছে। সেই অন্তর্নিহিত শক্তিকে পুঁজি করেই আমরা এগিয়ে যেতে চাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের আদলে আগামীর বাংলাদেশ গড়তে। সেই স্বপ্নিল সোনার বাংলা গড়ার কাজে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মন প্রাণ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর উদ্যম, স্বদেশ প্রেম, প্রশাসনিক দক্ষতা, গণমুখী চিন্তচেতনা নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এগিয়ে চলেছেন দৃপ্ত পদক্ষেপে। উন্নয়নের এই অভিযাত্রাকে আরো বেগবান ও টেকসই করতে আমাদের বেশ কিছু নীতিকৌশলের দিকে নিরন্তর মনোযোগী থাকতে হবে :

এক. অবকাঠামো উন্নয়নের অংশ হিসেবে মেগা-প্রজেক্টগুলোর বাস্তবায়নের ধারা এমনভাবে অগ্রাধিকার দিয়ে চালু রাখতে হবে যাতে করে সময়ের দাবি অনুযায়ী প্রযুক্তিগত সংযুক্তি বাড়ে। এর ফলে ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তারা প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদনে বেশি করে যুক্ত হয়ে আমাদের অর্থনীতিকে আরো দক্ষ করে তুলবেন। রপ্তানি আয় ও সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়ানোর লক্ষ্যেই এই ধরনের সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের অগ্রাধিকার বিন্যস্ত করতে হবে। এফডিআই বাড়লে বিদেশ থেকে নয়া জামানার ধ্যান-ধারণা ও প্রযুক্তির সংযোজন ঘটবে আমাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায়। ভিয়েতনাম ও কমবোডিয়ায় জিডিপির ৬ ও ৯ শতাংশ এফডিআই এলে আমাদের দেশে তা কেন এক শতাংশের গণ্ডিও পার হতে পারছে না? এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্যি আমাদের নীতি নির্ধারকদের খোঁজার চেষ্টা করতে হবে।

দুই. বিপুল হারে আমাদের শিক্ষিত তরুণদের জন্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। শুধুমাত্র সরকারি খাতে চাকুরির মধ্যমে তা সম্ভব নয়। তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তি-নির্ভর উদ্যোগে উৎসাহী করার জন্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, অর্থায়ন ও বাজার তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করে দেবার নীতি উদ্যোগ সরকারি ও ব্যক্তিখাতকে নিতে হবে। ই-কমার্স তথা ডিজিটাল ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যে নয়া ধারা অর্থায়নের সুযোগ অবশ্যি আমাদের তৈরি করতে হবে।

তিন. নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তারাই বেশি বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারবেন। সে জন্যে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমকে নতুন করে সাজাতে হবে। উদ্যোক্তা তৈরির জন্যে প্রয়োজনীয় উদ্ভাবন কেন্দ্র প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই স্থাপন করতে হবে। আমাদের সবচেয়ে সফল রপ্তানি শিল্প বস্ত্রখাতের প্রকৌশল ও ব্যবস্থাপক তৈরি করাকে অগ্রাধিকার হিসেবে উচ্চ শিক্ষানীতিতে যুক্ত করতে হবে।

চার. আমাদের সফল উদ্যোক্তারা যেন মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নে কোনো বাঁধার মুখে না পড়েন সে দিকে খেয়াল রেখে আর্থিক খাতের তিনটি রেগুলেটর কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সিকিউরিটি কমিশন ও বীমা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে সমন্বিতভাবে সুদূরপ্রসারি নিয়মনীতি উদ্ভাবন ও পরিচালনায় মনোযোগী হতে হবে।

পাঁচ. দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকে স্থিতিশীল করার জন্যে জ্বালানি সরবরাহ অপরিহার্য। বাংলাদেশ সনাতনি জ্বালানি উন্নয়নে বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। এসব উদ্যোগ সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগকে টেকসই করতে হলে প্রয়োজনীয় অর্থপ্রবাহ (দেশি-বিদেশি) নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি আগামী দিনের জ্বালানী অবশ্যি সবুজ উৎস থেকে সংগ্রহ করতে হবে। এখন থেকেই ওই দিকটায় নজর দিতে হবে। ঘরে ঘরে কী করে সবুজ জ্বালানী উৎপাদন করা যায় সে জন্যে প্রয়োজনীয় রাজস্ব-প্রণোদনা (‘নেট মিটারিং’-এর মাধ্যমে) নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে আমাদের প্রধান রপ্তানি শিল্পকে সবুজায়নে বড় মাপের আর্থিক সহযোগিতা ও প্রযুক্তিগত রূপান্তরের নিয়মনীতি চালু করতে হবে।

ছয়. জিঞ্জিরা, ধোলাইখাল, কেরানিগঞ্জ, যশোর ও বগুড়াসহ অসংখ্য হাল্কা প্রকৌশল কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রে লক্ষ লক্ষ ক্ষুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তা রয়েছেন। তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন দিয়ে, দেশি-বিদেশি বাজারের সাথে যুক্ত করা গেলে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানে এক ধরনের বিপ্লব আনা সম্ভব। নীতি-নির্ধারকদের এ দিকটায় নজর দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে শিল্পায়নেও বহুমুখীকরণ করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। বস্ত্র ও চামড়া ছাড়াও আমরা ওষুধ, সিরামিক, মটর গাড়ির যন্ত্রাংশ এবং তথ্য প্রযুক্তির পণ্য তৈরির শিল্পে বাড়তি মনোযোগ দিতে পারি।

সাত. শুধু শিল্পায়নের ওপর নির্ভরশীল না থেকে আমাদের কৃষির আধুনিকায়নের জন্যে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে যেতে হবে। এরই মধ্যে আমরা এ খাতে গবেষণা ও উন্নয়নের উপযুক্ত নীতি সমর্থন দিয়ে গত এক দশকে ব্যাপক উন্নয়নের ধারা চালু করেছি। ধান, পাট ছাড়াও পানি সম্পদ, শাক-সবজি ও ফলের উৎপাদনে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছি। কৃষি ও প্রাণি সম্পদের এই উন্নতিতে ক্ষুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অসামান্য অবদান স্বীকার করতে হবে। এ ধারা যাতে অব্যাহত থাকে সেজন্যে সরকারি বিনিয়োগ বছর বছর আরো বাড়িয়ে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমানোর জন্যে যন্ত্রায়ণসহ সকল উপকরণের দামে ভর্তুকির যে ধারা চালু করা হয়েছে তাকে টেকসই করতে হবে। কৃষকদের বিনিয়োগে প্রয়োজনীয় স্বল্পমূল্যের অর্থায়নের নীতিও চালু রাখতে হবে।

আট. বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সংযোগ বাড়াতে হবে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে রপ্তানি করার ঝোঁক কমাতে হবে। ভারত, জাপান, চীনসহ এশিয়ায় রপ্তানি বাড়াতে উদ্যোগী হতে হবে। চীন থেকে অনেক শিল্প বাংলাদেশে চলে আসছে। ভারত থেকেও বিদ্যুত ও রেলের যন্ত্রপাতি আসছে। তাই আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি করার এই ধারা আরো বেগবান করার সুযোগ রয়েছে। সেজন্যে বাণিজ্য সহায়তামূলক অবকাঠামো ও নীতিকাঠামো সংস্কারে আমাদের মনোযোগী থাকতে হবে। বাংলাদেশও সিংগাপুরের মতো এক নয়া বাণিজ্যিক আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সম্ভাবনা রাখে।

নয়. শুধু বিদেশে রপ্তানি নয় স্বদেশের বাড়ন্ত বাজারের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে আরো চার কোটি মানুষ দারিদ্র্য রেখা টপকে উপরে উঠে আসবে। প্রতি বছর পাঁচ হাজার ডলারের বেশি মাথাপিছু আয় করেন এমন ২০ লক্ষ মনুষ নয়া ধাঁচের ভোক্তা বাজারে আসছে। তাদের চাহিদা মাথায় রেখে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করতে হবে। আগামী এক দশকেই ৩৩টি শহরের প্রতিষ্ঠিত এমন মধ্য ও উচ্চ আয়ের ভোক্তার সংখ্যা তিন লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে। তারা আমাদের স্বদেশি ব্রান্ডের পণ্য কিনবে। তাই তাদের কথা মাথায় রেখে উন্নয়ন নীতিকৌশল সংস্কার করতে হবে।

দশ. সার্ভিস খাতেও মনোযোগ বাড়াতে হবে। বিশ্বের সাথে সংযোগ বাড়িয়ে আমরা ব্যাংক, বীমা, অডিট, ডিজাইনসহ নানা ধরনের কম্পায়েন্স নির্ভর সার্ভিস শিল্প ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে গড়ে তুলতে পারি। এর ফলে শিক্ষিত তরুণদের প্রচুর কাজের সুযোগ বাড়বে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজারকে আমরা ‘এভিয়েশন হাব’ হিসেবেও গড়ে তুলতে পারি।

এগারো. শিল্পায়ন দ্রুত হলে নগরায়নও দ্রুত হবে। উপযুক্ত নীতি না থাকলে নগরায়ণ বিশৃংখল রূপ নিতে পারে। তাই শিল্পকে পরিবেশ-বান্ধব এবং নগরায়ণকে সুশৃংখল করার দুরদর্শী নীতি কৌশলের প্রতি এখন থেকেই মনোযোগী হতে হবে।

বারো. এতসব উন্নয়ন করতে হলে বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহ ছাড়া কোনো উপায় নেই। মাথাপিছু আয় যে হারে বাড়ছে আমাদের করদাতার সংখ্যা সে হারে কিন্তু বাড়ছে না। মাত্র ২১ লক্ষ করদাতা নিয়ে আমরা কেন সন্তুষ্ট থাকব? এ সংখ্যা কেন এক কোটিতে উন্নীত করা যাবে না? স্বদেশপ্রেমের অংশ হিসেবে আনন্দঘন পরিবেশে নির্ভয়ে কর দেবার সংস্কৃতি গড়ে তোলার নীতিকে অগ্রাধিকারসহ বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে।

তেরো. তাছাড়া ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের জন্য শুধু ব্যাংকের ওপর নির্ভর না করে সবার জন্যে পেনশন ব্যবস্থা তাড়াতাড়ি চালু করে একদিকে সামাজিক নিরাপত্তার সুযোগ বাড়ানো এবং অন্যদিকে দীর্ঘ মেয়াদি অর্থায়নের টেকসই ভিত্তি তৈরি করা সম্ভব হবে। দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন যোগাড়ের আরেকটি উৎস হতে পারে সিএসআর খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে সামাজিক দায়বোধের অংশ হিসেবে ভালো অংকের সিএসআর সমর্থন দিতে ব্যাংকগুলোকে উৎসাহিত করা সম্ভব হয়েছিল। এ ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি প্রত্যেক বড় উদ্যোক্তাকে তাদের ট্যাক্স-পূর্ব আয়ের দুই শতাংশ সামাজিক ও পরিবেশগত ব্যয় (৫০:৫০) করার আইনগত বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে। ভারত তা করেছে। এই ব্যয় তাদের নিজস্ব অলাভজনক ফাউন্ডেশন অথবা রেজিস্টার্ড অলাভজনক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করতে হবে। এ জন্যে উপযুক্ত মনিটরিং এর জন্য হিসেব নীরিক্ষণ প্রতিষ্ঠানকে সংশ্লিষ্ট রেগুলেটর কাজে লাগাতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ কাজে খানিকটা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। সেই আলোকে একটি জাতীয় আইন ও বাস্তবায়ন নীতি প্রচলন করা যেতে পারে। এটা করা গেলে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বাজেট অনেকটাই কমে আসবে। ভারত এ বিষয়ে আইন করেছে এবং ‘করপোরেট অ্যাফায়ার্স’ নামের আলাদা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের কাছ থেকেও শেখা যেতে পারে।

প্রস্তাবনা আর বাড়াতে চাই না। উপরের এসব নীতি কৌশল জনগণের কল্যাণে কাজে লাগাতে হলে সকল খাতেই স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। বিশেষ করে আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা খুবই জরুরি। যেভাবে আমাদের তরুণ প্রজন্ম উদ্যোক্তা হতে চাইছে এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময় তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করছে তাতে মনে হয় বাংলাদেশ তার উন্নয়ন অভিযাত্রাকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাবেই। তাদের জন্য উপযুক্ত অর্থায়নের সুযোগ ও প্রণোদনা কাঠামো তৈরি করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। ব্যক্তিখাত, সরকারি খাত ও অলাভজনক সামাজিক খাত মিলে মিশেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা অর্জনে মনোযোগী থাকবে সেই প্রত্যাশাই করছি।

নাগরিক জীবনের কোলাহল, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বার্থের হানাহানি, ভণ্ডামি থেকে অনেক দূরে ছায়াঘেরা শান্তশীতল গ্রামীণ এক পরিবেশে তিনি এখন শায়িত। যাঁদের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন, তাঁরাই তাঁকে সাধারণের বেশে পরম আদরে শুইয়ে রেখেছেন। আজ তাই আমাদের একান্ত প্রচেষ্টা হওয়া উচিত কী করে আমাদের নীতিতে ও কর্মে তাঁর আজীবনের স্বপ্ন-সাধারণের কল্যাণ-ভাবনাকে যুক্ত করা যায়। কী করে আমাদের উন্নয়ন-ভাবনায় মানুষের চাওয়া-পাওয়াকে আরো গভীরভাবে যুক্ত করা যায় সেটিই এখন সময়ে দাবি। অনুসরণ করতে হবে তাঁরই দেওয়া উন্নয়ন নীতিমালার নানা বৈশিষ্ট্য। উদ্যোগ নিতে হবে আমাদের সমকালীন উন্নয়ন নীতি কৌশলকে কী করে বঙ্গবন্ধুর ভাবনাপ্রসূত সাংবিধানিক অঙ্গীকার-নির্ভর জনকল্যাণধর্মী, কৃষক ও  শ্রমিকদের জন্য আরো মঙ্গলাশ্রয়ী করা যায়। সেলক্ষ্যে আমাদের ফিরে আসতেই হবে। মুষ্টিমেয় কল্যাণের ঘোর বিরোধী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সর্বসাধারণের মঙ্গল-ভাবনায় সবসময় নিমগ্ন থাকা ছিল তাঁর স্বভাবের অন্তর্গত। তাই আজ আমরা যদি সত্যি তাঁর আদর্শের রূপায়ণ চাই, তাহলে আমাদের স্বতন্ত্র স্বদেশচিন্তায় উদ্ভাসিত উন্নয়ন-কৌশলকে আরো গরিবহিতৈষী ও লক্ষ্যভেদী করতে হবে। একই সঙ্গে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আগামীর উন্নয়ননীতিকে আরো উদ্যোক্তা-বান্ধব করতে হবে।

২০২০ সালে আমরা যেন সমৃদ্ধ বাংলাদেশেই সর্বশ্রেষ্ঠ এই বাঙালির জন্মশতবর্ষ মাথা উঁচু করে উদযাপন করতে পারি সেই প্রত্যাশা করছি। তার পরের বছরই স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স হবে পঞ্চাশ। বঙ্গবন্ধুর গরিবহিতৈষী উন্নয়ন কৌশলকে বাস্তবে রূপায়ণে ব্রতী হয়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করতে চাই। ।

ড. আতিউর রহমান
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গর্ভনর, বাংলাদেশ ব্যাংক

   

তাপমাত্রা, পাপমাত্রা ও এসি-ফ্যান হাতপাখা



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

গোটা এশিয়া জুড়ে এবার উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাব লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশের উচ্চতাপমাত্রা যেমন নজর কেড়েছে তেমনি প্রাণ ওষ্ঠাগত করে বিপদে ফেলেছে মানুষকে। কেউ কেউ মজা বা উপহাস করে বলে বেড়াচ্ছে, মানুষের পাপ কাজের মাত্রা বেড়েছে। পাপ কাজকে কেউ এখন আর তেমন ঘৃণা করেনা, ভয়ও পায় না। কারণ এদেশের মানুষ সিংহভাগই ধর্মপ্রাণ। এদেশের মতো এত বেশি মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না। মানুষ পাপ কাজ করে আর ধর্মীয় উপাসনা করে প্লাস-মাইনাস থিওরিতে মনের ভারসাম্যতা এনে আত্মতৃপ্তি লাভ করে।

কিন্তু সেই আত্মতৃপ্তি সবার ক্ষেত্রে টেকসই হয় না। কারণ, মানুষ বার বার তওবা করে আবার বার বার পাপ কাজ করতে উদ্যত হয়ে ওঠে। ফলে সীমা লঙ্ঘণ করার অপরাধেপ্লাস-মাইনাস থিওরিতে মনের পাপ বিদূরিত হয় না। বরং আরো বেশি কালিমা লেপন হয়ে যায়। ফলত: পাপের বোঝা ক্রমাগত ভারী হয়ে উঠায় বর্তমানে পাপমাত্রা বেশি ভারী হয়ে অসহনীয় হয়ে উঠেছে!

এছাড়া শুধু প্রার্থনা না করলেই পাপ হয় অথবা প্রার্থনা না করলেই মার্জনা হয় এমন ধারণা সব ধর্মের সবাই মানতে নারাজ। ইসলামে ধর্মীয়ভাবে হয়তো সীমা লঙ্ঘণকারীদের জন্য এই ধারণা সঠিক কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে সীমালঙ্ঘণকারীদের বেলায় কি হবে?

মানুষ নিজেদের আরাম আয়েশের জন্য প্রকৃতির ওপর নির্বিচারে নিষ্ঠুরতা চালিয়ে উল্লাসে মেতে উঠেছে। উন্নয়নের নামে প্রকৃতির সবুজ গায়ের চামড়া তুলে কালো পশমি চাদর ও জামা পরিয়ে দিয়েছে। গরমের মৌসুমে মানুষ বা কোনো প্রাণী কি কালো পশমী কোট পায়ে দিয়ে থাকতে পারে?

আধুনিকতার নামে শহরের ব্যাপ্তি ঘটছে প্রতিটি দেশে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির নামে গোটা পৃথিবীর বুক জুড়ে কংক্রিট ও কালো পিচের ঢালাই এঁকে দেয়া হয়েছে। ক্ষমতার লোভে যুদ্ধের দামামা চালিয়ে সাইরেন বাজিয়ে বোমা বারুদ ফাটিয়ে পৃথিবীর শান্ত সুন্দর পরিবেশকে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। আরাম আয়েশের জন্য এসি, কুলিংফ্যান, ফ্রিজ নামক কীট মানুষের গাড়ি, বাড়ি, অফিস, আদালত, রিসোর্ট প্রভৃতিতে খামচে বসে অনর্গল উচ্চ তাপমাত্রা ও বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে দিয়ে উপহাস করছে। কার্বন কমানোর নামে সেমিনার, কনফারেন্স, কনভেনশন করতে গিয়ে বেটো দিয়ে ওয়াক আউট করে চলে যাচ্ছে স্বার্থের সংঘাতের কারণে। মারণাস্ত্র বিক্রি করে যাদের জাতীয় ও বার্ষিক আর্থিক বাজেট নিরুপণ করা হয় তারা এ ব্যাপারে শুধু ভণিতা ছাড়া আর কি করতে পারে? তাই পাপমাত্রা শুধু ধর্মপ্রাণ মানুষকে কেন্দ্র করে প্রার্থণার উপর নির্ণীত করাটা বড় ভুল হবে। পাপের মাত্রাটা নির্ভর করছে বড়বড় অর্থনীতির বড় বড় মেগা কর্মকান্ডের ফলে প্রকৃতির উপর ব্যাপক হারে নিষ্ঠুরতা চালানোর মধ্যে।

আসলে যুদ্ধের উন্মাদনায় পড়ে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে কেউই তেমন পাত্তা দিচ্ছেন না। কিছুদিন আগে বলা হতো- পৃথিবী আর দেড় বছরের মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ হারাবে। হঠাৎ করে এখন বলা হচ্ছে, দেড় বছর নয় আর মাত্র দেড় মাসের মধ্যে পৃথিবীর ভাগ্য জানা যাবে (বিবিসি)। কারণ, আর মাত্র দেড় মাসের মধ্যে যে বিশ^ পরিবেশ সম্মেলন হতে যাচ্ছে সেখানে বড় বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর ভূমিকা কি হবে তা দেখার মতো বিষয়। সেখানে নির্ধারিত হবে কার্বন নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন নীতিমালা।

রাশিয়া গ্যাস সরবরাহে ইউরোপের উপর থেকে অবরোধ তুলে না নেয়ায় গোটা ইউরোপে কাঠ ও কয়লার ব্যবহার বেড়ে গেছে। তাই ইউরোপে অতি বেশি কার্বণ নির্গমণ হতেই আছে। এটা আরো কতদিন বা বছর কলবৎ থাকবে তা বোঝা মুষ্কিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাবস্থায় ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ চলছে। ইরান, লেবাননসহ গোট মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি। সবার সামরিক উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে এবং দ্রব্যমূল্য আরো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে।

বিশ্ববাণিজ্য ও জরুরি খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ আরো বেশি সংঙ্কুচিত হয়ে পড়লে বিশ্বমন্দা নিয়ে মানুষ আরো বেশি হতাশ হয়ে যাবে। তখন ধনী দেশগুলো কার্বন নিঃসরণের জন্য কোনরুপ অর্থ ব্যয় করতে মোটেও রাজি হবে না। ফলে গোটা বিশ্ব অচিরেই একটি চরম ক্রান্তিকালের মুখোমুখি এসে উপনীত হয়েছে। সেখান থেকে অচিরেই কোন মুক্তির পাবার আশা করা বৃথা।

এতো গেল ইউরোপের ধনী দেশগুলোর কথা। করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট,বন্যা, দাবানল, ডেঙ্গু, মরুর দেশ আমীরাত ও ওমানে আকস্মিক অতিবৃষ্টি ও ফ্লাশফ্লাড, ইত্যাদি নিয়ে গোটা পৃথিবীতে কঠিন অর্থনৈতিক আঘাত লেগে গেছে। বড় আঘাতে ইতোমধ্যে আফিকা ও এশিয়ার ছোট ছোট ১৬টি দেশ নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে। দেশে দেশে জ্বালানী সংকট ও উচ্চদ্রব্যমূল্য চোখে পড়ার মতো অবস্থায় জানান দিচ্ছে সামনের ভয়াবহ আশঙ্কার কথা।

আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ষোল হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার মাত্রা সফলভাবে প্রচারিত হলেও সাম্প্রতিক ভয়াবহ তাপপ্রবাহ ও জরুরি এলার্টের ফলে মানুষ ঘরে বসে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে। এসময় বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার ঘন ঘন লোড শেডিং মানুষকে জানান দিচ্ছে- এটাই যথেষ্ট নয়। এখন ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার সংখ্যা কত কোটি হয় তা কারো জানা নেই। অটোর চার্জ, সেচ মেশিনের অতি ব্যবহার ও অতি গরমে গ্রামের মানুষও দেশীয় তৈরি সস্তা এসি কিনে ঘরে ঘরে লাগাচ্ছে। তাই বিদ্যুতের সংকট আরো বেশি ঘণীভূত হচ্ছে।

আমি একজন আশাবাদী মানুষ। চিরকাল আশা ও ভরসার মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর সকল হতাশাকে জয় করে মানুষ বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাক সেই চেষ্টা করি। এখনো করছি এবং ভবিষ্যতে সেটা করেই যাব। কিন্তু মানুষের কাজের গতি বন্ধ হয়ে গেলেই তো সম্ভাব্য বিপদের হাতছানি চলে আসে।মানুষের দেহে যেমন রক্তপ্রবাহ সঠিক থাকা জরুরি ঠিক তেমনি একটি দেশের সারাদেহে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্দুৎপ্রবাহ থাকাটা খুব জরুরি।

সমস্যাটা এখানেই অনুভব করছি। পড়াশুনা ও গবেষণার জন্য দীর্ঘদিন জাপানে ছিলাম। প্রথমদিকে দেশ থেকে জাপানে গিয়ে মনে হতো সেখানে কি রাত হয় না? রাতের রাস্তায় কারো ঘুম নেই। সেটা গাড়ি, ট্রেন বা মানুষের। কোনো শব্দ নেই শুধু আলো আর আলো। সবাই শিফট বদল করে নিজের কাজ করেই যাচ্ছে। ওর মধ্যেই বিরাম, বিশ্রাম চলছে। কেউ কাউকে কোনভাবেই বিরক্ত করছে না। ওরা তো গ্যাস, তেল সবই কিনে আনে। নিজের কিছুই নেই। তবুও ওদের অভাব নেই। ও হ্যাঁ, এখনো ঢাকার চেয়ে টোকিও বা পাশের শহরতলির নির্মাণ খরচ ও জমির দাম অনেক কম। ওদের তো বিদ্দুৎ রেশনিং করতে হয় না। ওখানে এক মিনিট কেন, এক সেকেন্ডের জন্য বিদ্দুৎ কোথাও চলে যায় যায় না। কারণ ওরা খুব সৎ ও কর্মঠ। ওরা মুখে প্যাঁচ প্যাঁচ করে বাহুল্য কথা বলে না। কথায় ও কাজে সততাকে প্রমাণ করে দেখায়। আমরা চোরের খনিতে বাস করি। এটা নতুন কথা নয়। রেন্টাল বিদ্দুৎ-এর প্রভাবে টাইকুনরা এই চরম বিপদের সময় চুপ করে আছেন কেন?

এপ্রিল শেষ হলো কোনা বরিষণের দেখা নেই। আবাদী জমি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্চে। সেচ দেবার উপায় নেই। কারণ, পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। সাথে চরম অভাব লেগেছে বিদ্যুৎ সরবরাহে।

গতবছর প্রথম দেশে জানা গেছে লোডশেডিং-এর প্রাতিষ্ঠানিকিীকরণ করার কথা। সেটা সরকারিভাবে রাখঢাক না করে সময়সূচি ধরে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই ঘোষণা অনুযায়ী লোডশেডিং-এর ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে না বলে সারা দেশের জনগণ অভিযোগ করে চলেছেন।চাহিদা অনুযায়ী দুরে থাক্, এমনিতেই তো বিদ্দুৎ থাকে না। চাহিদা মতো ভোক্তাকে বিদ্দুৎ দিতে না পারলে তো ক্ষমা চাইতে হয়। এটা আমাদের কৃষ্টিতে নেই অথচ, ক্ষমা চাওয়াটাই ভাল উপায়। তা না করে লোডশেডিং-এর অনিয়ম কথাটা শুনতে ও বুঝতে গিয়ে অনেকে আরো বেশি কষ্ট পাচ্ছেন, হতাশ হয়ে পড়ছেন।

এবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রাইমারি স্কুল খোলা। দেশে এসি সম্বলিত ক্লাসরুম কয়টি বিদ্যালয়ে আছে? এই ভয়াবহ গরমে সবার আগে কোমলমতি শিশুদের জন্য স্কুল বন্ধ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও তা বলবৎ করা হচ্ছে না। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবাই হলে থাকে না। ফলে অনলাইনের খরচে কারণে শিক্ষার্থীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে সংকটে পড়ে অনুপুস্থিত থাকছে।

এগুলোই আমাদের দেশের সেবাদানকারীদের সাথে উন্নত কোন দেশের সেবাদানকারীদের তফাৎ। কেউ কি সেটা বুকে হাত দিয়ে অস্বীকার করতে পারবেন? জোড়াতালি দেয়া জীবনে আমাদের সবাইকে কেন বিদ্যুৎ কষ্টে থাকতে হবে? অভিজাত এলাকা ও বস্তি বা দুর্গম গ্রামীণ এলাকায় বাস করা সবাই তো রক্তমাংসের মানুষ। তাদের কারো শরীরে কি ঠান্ডা ও গরমের মধ্যে অনুভূতির কি কোন পার্থক্য আছে?

লোডশেডিং-এর জন্য যাদের চারতলার চৌবাচ্চায় কৃত্রিম পানি তুলে শিং-মাগুর মাছের প্রজেক্ট আর চলছে না, যাদের ছাদবাগানের গাছগুলো পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে তাদের কথা আলাদা করে ভাবার অবকাশ নেই। রাজধানীর কোনো কোনো রাস্তায় সিটি কর্পোরেশনের কতটি গাড়ি পানি ছিটাচ্ছে বস্তি এলাকার কলসি কাঁখে খাবার পনি সংগ্রহ করতে যাওয়া দরিদ্র মানুষগুলোর নিকট সেটাও খুব বাহুল্য বা কৌতুক মনে হচ্ছে। যাদের প্রিয় ছেলের কিনে দেয়া এসিটাও চালানো যাচ্ছে না,আইপিএসে চার্জ না হওয়ায় সিলিং ফ্যানও ঘুরছে না তাদের জন্য সবকিছু হতাশার মধ্যে নিপতিত হলেও তালের হাতপাখা দু’টো কিন্তু চালানো যাবে। কারণ, আমি আশাবাদী মানুষ। মরুশহর দুবাইয়ে হঠাৎ তীব্র বন্যার মাত্রা ওদের অধিবাসীদের পাপমাত্রার কারণে ঘটেছে তা বলা মুষ্কিল। কারণ সেখানে শত শত ভিন্নধর্মাবলম্বী লোকের বাস। কিন্তু আমাদের দেশের ওপর কি হলো? বিপদ বার বার আসে এজন্য বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতেই হবে। আর এজন্য আগাম বড় পরিকল্পনা এখনই গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। 

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

 

;

রক্তচক্ষু উপেক্ষার সাহস না থাকলে সাংবাদিকতা নয়



আশরাফুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের বরপুত্র নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ঘুমন্ত জনগণকে জাগাতে বহু যুগ আগে উচ্চারণ করেছিলেন এক চরম সত্য। তিনি বলেছিলেন, ‘Freedom is not given, it is taken’. ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক, স্থানিক বা বৈশ্বিক সব স্তরেই এটি আজ চরম সত্য হিসেবে বিশ্বের পরাধীন কোটি মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়।

৩ মে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস (World press freedom day) ঘিরে নানা আয়োজন চলে বিশ্বজুড়েই। প্রকাশিত হয়েছে অগণিত সম্পাদকীয় নিবন্ধ। মুক্ত সাংবাদিকতার পথ প্রশস্ত করার দাবি নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিমের দেশে দেশে পথেও নামেন সাংবাদিকরা। যদিও সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ, হত্যা-নির্যাতন, হুমকি-অপহরণের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি থেমে নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতি বছরই চলে এমন আয়োজন ও কর্মসূচি।

বলতে দ্বিধা নেই- ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতাহীন কেউই সাংবাদিক নিপীড়নে পিছিয়ে নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোর দিকে যদি আমরা দৃষ্টি দিই, তবে এমন ঘটনার দৃষ্টান্ত বহু দেওয়া যাবে। ক্ষমতাসীনদের হাতে সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনাকে যদি বাধ্য হয়ে ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা হিসবে মেনেও নিতে হয়, কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলের যারা সরকারকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে মুখে ফেনা তুলেন তাদের হাতেও যখন সাংবাদিকরা নিগৃহীত হন তখন তার কোন সদুত্তর মেলে না!

২০২৩ সালে ২৮ অক্টোবর বিএনপি নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোটের সমাবেশে দায়িত্বরত সাংবাদিকদের ওপর বর্বর হামলার ঘটনা ঘটে। কিছু দিন চলে হইচই। সময়ের সঙ্গে সেইসব ঘটনা চাপা পড়ে যায় নতুন ঘটনার ঘনঘটায়। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলির যে কোন দায়বোধ নেই তা প্রমাণিত, তাই কোন তদন্তও হয় না-শাস্তি তো বহু দূরের ব্যাপার।

সংবাদকর্মীদের গায়ে আঘাতের ক্ষত না শুকাতেই ঘটনায় জড়িত রাজনৈতিক নেতারা প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে চা-আড্ডায় মেতে উঠেন। প্রহৃত সাংবাদিকদের কেউ কেউ হয়ত উঁকি দিয়ে সেই আড্ডা দেখে ফেলেন, কিন্তু প্রভাবশালীদের কাছে হার মেনে নীরব অভিমানে সরে আসেন তারা।

সবশেষ, এফডিসিতে চলচ্চিত্রের খল অভিনেতাদের নেতৃত্বে বিনোদন সাংবাদিকদের ওপর যে নারকীয় হামলার ঘটনা ঘটলো তার কি বিচার হলো? এক অভিনেতার বাসায় কতক সাংবাদিক নেতার গোপন মিটিংয়ে ঘটনার আপসরফার খবর শোনা গিয়েছিল। একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সংবাদও গণমাধ্যমে এসেছে। বেশ কিছু দিন পেরিয়ে গেলেও কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না।

এবারের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের পরদিন শনিবার যখন এই দিবস নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আলোচনা সভা হয় সেখানে ‘বিষয়’ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল ‘পরিবেশ ও উন্নয়ন সাংবাদিকতাকে’; সাংবাদিক নিপীড়নের প্রসঙ্গ ছিল সেখানে গৌণ। শীর্ষ গণমাধ্যমের সম্পাদক থেকে শুরু করে স্বয়ং তথ্য প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের অতিথি। নির্যাতিত কমিউনিটির মাঝেই যদি এমন আপস করার প্রবৃত্তি আর ক্ষমতার আশীর্বাদ পাওয়ার ব্যাকুলতা থাকে তবে সাংবাদিক নিগ্রহের প্রতিকার দাবি করাই তো একটা ‘অপরাধ’!

শুরুতেই স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষের প্রসঙ্গ এসেছে। তিনি যে কেবল মুক্তিকামী মানুষদের ‘স্বাধীনতা’ ছিনিয়ে নেওয়ার কথা বলেছিলেন তাই নয়, জাতীয় কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতি সুভাষচন্দ্র বসু এক ভাষণে আমাদের মজ্জাগত দাসত্বের প্রবৃত্তিকেও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে, ‘বন্ধুগণ, আমরা দাস হয়ে জন্মেছি। আসুন সংকল্প করি, আমরা মরবার পূর্বে স্বাধীন হব।’

সত্যিকথা বলতে চারপাশে কেবল দাসত্ব আর তোষামোদি দেখে দেখে আমরা নির্বিকার হয়ে পড়েছি। সাংবাদিকতায় আমরা যাদের পরম্পরা বহন করছি, সেই গৌরবের ইতিহাস আমাদের সামান্যই প্রভাবিত করছে।

১৯২২ সালের ১১ আগস্ট। প্রাণভরে সত্য উচ্চারণের আকাঙ্খা নিয়ে বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতার ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিট থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করছিলেন অর্ধ-সাপ্তাহিক ধুমকেতু। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা কতটা প্রাতঃস্মরণীয় আখ্যান সৃষ্টি করতে পারে ধুমকেতু তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সমকালীন সাংবাদিক ও সম্পাদকদের সেই ঘটনা স্মরণ করা এই জন্য জরুরি যে, মহান এ পেশার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আমাদের আরও কতটা সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন তারই খানিকটা ধারণা পাওয়া যাবে সেই ঘটনার আখ্যানে।

শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের মালিকানাধীন সান্ধ্য-দৈনিক নবযুগের সম্পাদনায় নিজের চিন্তা ও স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা অনুভব করে তরুণ কবি নজরুল নিজেই ‘ধুমকেতু’ নামে নিজেই একটি সংবাদপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কাছে চেয়ে পাঠান আশীর্বাদ বাণী। কবিগুরুও তাকে ফেরান না। রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদবাণীসহ প্রকাশিত ধুমকেতু একটি ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলতে কি অনন্য ভূমিকাই না রাখে! সাহিত্যিক ও কবিবন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘‘জাতির অচলায়তন মনকে অহির্নিশি এমন করে ধাক্কা মেরে চলে ‘ধুমকেতু’ যে রাজশক্তি প্রমাদ গণে।’’

পরাধীন দেশে নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ ধুমকেতুর যে কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল তা যেন অঙ্গিস্ফূলিঙ্গ হয়ে রাজশক্তির সিংহাসনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। কালজয়ী সব কবিতা আর জ্বালাময়ী সম্পাদকীয় নিবন্ধে নজরুল স্বাধীনতার কথাকেই প্রবল পরাক্রমে বলতে পেরেছিলেন ধুমকেতুতে।

ধুমকেতুর একটি সংখ্যার সম্পাদকীয় নিবন্ধে নজরুল লেখেন, ‘..সর্বপ্রথম, ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়..ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসন-ভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে দেশকে শ্মশান-ভূমিতে পরিণত করছেন, তাঁদেরে পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা পুঁটুলি বেঁধে সাগর-পাড়ে পাড়ি দিতে হবে…’-কি দুঃসাহসিক উচ্চারণ!

‘ধুমকেতুর কবি নজরুল’ শীর্ষক স্মৃতিচারণমূলক এক লেখায় পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় এক ঘটনার বয়ান লিপিবদ্ধ করেন। তিনি যা তুলে ধরেন তার সারমর্ম হচ্ছে, একদিন ধুমকেতুর কার্যালয়ে গোপীনাথ নামে এক যুবক স্বভাবসুলভ উৎফুল্ল কবি নজরুলকে প্রশ্ন করে বসেন, ‘দেশ পরাধীন, সাহেবদের অত্যাচার-জুলুম দিন দিন বেড়ে উঠছে। সেই জ্বালার মধ্যে আনন্দ জাগে কি করে?’

দেখা গেল কয়েক দিনের মধ্যে ওই যুবকটি কলকাতা চৌরঙ্গীর মোড়ে পিস্তল সহ হাতেনাতে ধরা পড়ল। যুবকটির নাম গোপীনাথ, অমর বিপ্লবী। অবশ্য ধরা পড়ার পূর্বে পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট মনে করে ডে সাহেব নামে আরেক ইংরেজকে গুলি করে হত্যা করেন ওই বিপ্লবী। সেই ঘটনার ডামাঢোলের মধ্যেই নজরুল লিখে ফেললেন, ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ শীর্ষক এক জ্বালাময়ী কবিতা। ধুমকেতুতে তা প্রকাশিত হলে নড়েচড়ে বসে ব্রিটিশ পুলিশ। যে কবিতায় কবি লিখেছিলেন, ‘‘আর কত কাল থাকবি বেটী/মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে/অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল/দেবশিশুদের মারছে চাবুক/বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি/ভূ-ভারত আজ কসাইখানা আসবি কবে সর্বানাশী’’

ফল যা হবার তাই হল, ধুমকেতু অফিসে হানা দিল পুলিশ। কুমিল্লা থেকে আটক হলেন নজরুল। আদালতে অকুতোভয় নজরুল যে জবানবন্দী দেন তা কেবল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেই নয়, মুক্ত সাংবাদিকতার ইতিহাসেও এক দৃষ্টান্ত। কবি দৃপ্তকণ্ঠে আদালতে উচ্চারণ করেন, ‘সত্য স্বয়ংপ্রকাশ তাকে কোন রক্ত আঁখি রাজদণ্ড নিরোধ করতে পারে না..’।

১৯২৩ সালের জানুয়ারিতে কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট মি. সুইনহো ধুমকেতু সম্পাদক কবি নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। কারা অন্তরীণ নজরুল আলিপুর সেন্ট্রাল জেল হয়ে হুগলী কারাগারে স্থানান্তরিত হন। সেখানে বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে দীর্ঘ ৩৯ দিন অনশন করে পরাধীন জাতিকে তিনি এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন। এই সময়ে কবিগুরু তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করলেন তরুণ কবি নজরুলকে । কাজী নজরুল ইসলামের বীরোচিত এই আখ্যান যেমন বাংলা সাহিত্যের পরিমণ্ডলে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা, তেমনি মুক্ত সাংবাদিকতার ঐতিহ্যিক পরম্পরাতেও এক চির অনুপ্রেরণা।

সমকালীন সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার অন্দরে প্রবেশ করে যদি আমরা আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে স্মরণ করি তবে লজ্জায় নত হতে হয়। সাংবাদিকতার মানস-মূল্যবোধ আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! একটি স্বাধীন দেশে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আমরা স্বাধীনতার জন্য রীতিমতো ‘কান্নাকাটি’ করছি। অথচ সত্য উচ্চারণে চিরকালই বাধা আসবে, গ্লানি থাকবে-তবু সত্যকে আলিঙ্গন করতে হবে-সাংবাদিকতায় এটিই বাস্তবতা। সেখানে সত্য উচ্চারণের পথ এতটা নিষ্কণ্টক হবে তা আমরা আশা করি কি করে? অতীত যেন আমাদের ভৎর্সনা করে বলছে, ‘বাধাকে, রক্তচক্ষুকে ডিঙিয়ে যাওয়ার সাহস যদি না-ই থাকবে তবে এ পথ তোমার নয়’।

সমকালীন বাস্তবতাকে যদি বিবেচনায় আনি তবে যা স্পষ্ট হয়ে উঠছে তা হল-ঔপনিবেশিক ও নব্য ঔপনিবেশিক দুঃশাসন থেকে মুক্ত হয়ে আমরা যে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পেয়েছি সেখানেও আমাদের চ্যালেঞ্জ কম নয়। বলতে গেলে বর্তমানে রাজনীতি, প্রশাসন আর বণিকশ্রেণীর মাঝেও এক প্রবল ঔপনিবেশিক চরিত্র ধরা দিয়েছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে, আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক তথা বৈশ্বিক ক্ষমতার সমীকরণও। এই সময়ের সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রকে একসঙ্গে এই সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কতটা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে প্রস্তুত?

যা দৃশ্যমান হচ্ছে, দ্ব্যর্থহীনভাবে আত্মসমালোচনা করলে বলতেই হবে, বহুলাংশেই আপস করছি আমরা। সত্য উচ্চারণে কিছু কণ্ঠস্বর কখনো জ্বলে উঠে আবার স্থিমিত হয়ে যাচ্ছে কিংবা থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু জ্বলে উঠা এই কণ্ঠস্বরগুলো যদি সংঘবদ্ধ করা যায় তবে অচলায়তন ভেঙে দেওয়া অসম্ভব নয়। আসুন আমরা সেই অভিপ্রায়কে বাস্তব করতে উদ্যত হই।

লেখক: বার্তা২৪.কম এর পরিকল্পনা সম্পাদক ও ইতিহাস গবেষক

;

বন্যা আসছে, প্রস্তুতি নিন!



কবির য়াহমদ
বন্যা আসছে, প্রস্তুতি নিন!

বন্যা আসছে, প্রস্তুতি নিন!

  • Font increase
  • Font Decrease

তীব্র তাপদাহ শেষে স্বস্তির বৃষ্টির দেখা পেয়েছে দেশ। দেশের অন্য এলাকাগুলোর অনেকগুলোতে এখনো তাপের তীব্র দহন থাকলেও সিলেট অঞ্চলের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। এখানে প্রায়ই যেন নিয়ম করে বৃষ্টি নামছে, তাপমাত্রা পরিস্থিতিও মোটামুটি সহনীয়। দেশ যখন পুড়ছে তাপে, তখন দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা বিশেষ করে সিলেটে দেখা দিয়েছে বন্যার আশঙ্কা।

বন্যার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় যে খেতের ধানের, এটা এবার কৃষকেরা ঘরে তুলতে শুরু করেছেন। অনেক এলাকার ধান কাটা শেষের পর্যায়ে। এখন চলছে ধান শুকানো আর গোলায় তোলার পালা। কেবল ধানই নয়, খড়ও শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে শুরু করেছেন তারা, কারণ এই খড় গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বোরো ধান দেশের খাদ্যচাহিদার অন্তত ৫৫ শতাংশ মিটিয়ে থাকে। দেশের হাওরভুক্ত ৭টি জেলা সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাওরে এই বোরোর চাষ বেশি হয়ে থাকে। এই ধান অতিবৃষ্টি, বন্যা ও ভারতের পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত না হলে দেশের খাদ্যচাহিদায় ঘাটতি পড়ে না। তাই এই ধান চাষ থেকে শুরু করে ঘরে ফসল তোলা পর্যন্ত অনুকূল আবহাওয়া, বিশেষ করে রোদের উপস্থিতি অতি জরুরি। ভালোয়-ভালোয় শেষ পর্যায় এটা শেষের পথে। তবে এখন উঁকি দিচ্ছে বন্যার শঙ্কা।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর পরিচালিত বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোর নদীগুলোতে পানির স্তর দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা বেশ কয়েকটি অঞ্চলে আকস্মিক বন্যার ঝুঁকি তৈরি করছে। প্রতিষ্ঠানটি পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে। এফএফডব্লিউসি বলছে, সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে প্রাক-বর্ষার পানিপ্রবাহ অতিক্রম করতে পারে।

পূর্বাভাসে যখন আকস্মিক বন্যার তথ্য, তখন ঠিক ঠিক সিলেট অঞ্চলের নদ-নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধির তথ্য মিলছে। এরইমধ্যে সিলেটের দুটি নদ-নদীর পানি শুষ্ক মৌসুমের বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, ভারতে কয়েক দিন ধরে বৃষ্টির ফলে সিলেটের নদ-নদীগুলোয় পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃহস্পতিবারই দুটি পয়েন্টে নদীর পানি শুষ্ক মৌসুমের বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। পাউবোর তথ্যমতে, সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে শুষ্ক মৌসুমের বিপৎসীমা ১০ দশমিক ৮০ মিটার। বর্ষা মৌসুমে বিপৎসীমা ১৩ দশমিক ৭৫ মিটার। শুক্রবার সকাল ৯ টা থেকে সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে ১১. ০৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একইভাবে সারি নদের জৈন্তাপুরের সারিঘাট পয়েন্ট শুষ্ক মৌসুমে বিপৎসীমা ১০ দশমিক ৭০ মিটার। বর্ষা মৌসুমে বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৩৫ মিটার। নদের ওই পয়েন্ট পানি ১১ দশমিক ৮৭ মিটারে অবস্থান করছিল, যা শুষ্ক মৌসুমের বিপৎসীমার ওপরে। এ ছাড়া সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্ট এবং কুশিয়ারা নদীর শেওলা পয়েন্টেও পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। তবে ভারতের বৃষ্টিসৃষ্ট ঢল নামতে থাকলে অন্য পয়েন্টগুলোতে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।

২০১৭ সালের মতো এবার দেশের বেরো খেত বন্যায় তলিয়ে যায়নি। কৃষকেরা আনন্দ লুট হয়নি বন্যায়। তবে ঘরে ফসল তোলার পর পরই বন্যার যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে সেটা ভাবনার। এমনিতেই ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার স্মৃতি বিস্মৃত হতে পারেনি সিলেট অঞ্চলের মানুষ। অবর্ণনীয় দুর্ভোগের পাশাপাশি জানমাল, আর্থিক ও অবকাঠামোগত যে ক্ষতি সেটা পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এখনো সিলেটের অনেক অঞ্চলে দুই বছর আগের সেই বন্যার ক্ষতচিহ্ন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

২০২২ সালের বন্যায় তলিয়ে গিয়েছিল সিলেট নগরসহ জেলার প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা। দীর্ঘমেয়াদি ওই বন্যায় মাসখানেক সময় দুর্ভোগ পোহাতে হয় মানুষকে। বন্যার পর দাবি ওঠেছিল সুরমা নদী খননের। এনিয়ে কিছু কাজ শুরু হলেও সেটা সমাপ্ত হয়নি। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সিলেট নগরের কুশিঘাট থেকে বিশ্বনাথের দশগ্রাম পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার খনন কাজ শুরু হয়েছিল। এই ১৫ কিলোমিটারের খনন কাজ ১৫ মাসেও শেষ হয়নি। অথচ এই প্রকল্প চার মাসে সম্পন্ন করার কথা ছিল। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যের কারণে খননকাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ জন্য নির্ধারিত সময়ে খননকাজ শেষ করা যায়নি। প্লাস্টিক ও পলিথিনের কারণে মেশিনারি যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে যায় বলে তাদের দাবি। শতভাগ সম্পন্ন করতে না পারলেও ৮০ ভাগ কাজ আগামী জুনের মধ্যে তারা সম্পন্ন করতে পারবেন বলেও তারা আশাবাদী।

গত বন্যার পর সুরমা নদীর নাব্যতা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, দাবি ওঠেছে নদী খননের। কেবল বন্যার ওই সময়ই নয়, সামান্য বৃষ্টিতেও সিলেট নগর ডুবে যাচ্ছে। খাল-ছড়াগুলো দখলে-দূষণে সংকীর্ণ, এবং অনেকগুলো ‘নাই’ হয়ে গেছে। ফলে সামান্য বৃষ্টি নগরে সৃষ্টি করছে জলাবদ্ধতা। তার ওপর আছে সিটি করপোরেশনের নানা উন্নয়নমূলক কাজ, যেগুলো পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহকে কোথাও কোথাও সৃষ্টি করছে বাধার। শুষ্ক মৌসুমের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে পানির গতিপ্রবাহ নিয়ে ভাবা হয় সামান্যই, ফলে গ্রীষ্মের প্রকল্প বর্ষা পর্যন্ত দীর্ঘায়ত হয়ে যাওয়ার কারণে পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে দেখা দিয়েছে প্রতিবন্ধকতা। আর শেষ পর্যন্ত তাই ভোগান্তির গন্তব্য মানুষ। এছাড়াও আছে হাওর এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক ও ভৌত অবকাঠামো, যেগুলো হাওরের বিশাল জলরাশির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত ‘তিস্তা নদী অববাহিকা: সংকট উত্তরণ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সপ্তম আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলনের ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও এনভায়রনমেন্ট গভার্নড ইন্টিগ্রেটেড অর্গানাইজেশনের পরিচালক জয়ন্ত বসু ‘জিওপলিটিকস অফ রিভার তিস্তা অ্যান্ড নিড টু পারসু নেচারবেইজড নেগোশিয়েটেড অ্যাপ্রোচ (এনবিএনএ)’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার আন্তদেশীয় নদীর সমস্যা আঞ্চলিক ভূরাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, এই অঞ্চলের সব দেশ প্রধানত কৃষি, জলবিদ্যুৎ এবং অন্যান্য কারণে নদীর ওপর প্রবলভাবে নির্ভরশীল। আর তাই এ অঞ্চলের অসম রাজনৈতিক ক্ষমতার উপস্থিতি; আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও স্থানীয় রাজনৈতিক সম্পর্কের প্রভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তন আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। আন্তদেশীয় নদীর পানি ব্যবহারে সমন্বিত মডেল বাস্তবায়নে আন্তদেশীয় স্টেকহোল্ডার পর্যায়ে আলোচনার আহ্বান জানিয়ে জয়ন্ত বসু বলেছিলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনো সামগ্রিক অববাহিকাভিত্তিক পদ্ধতি নেই। যদিও উভয় দেশের মধ্য দিয়ে ৫৪টি আন্তসীমান্ত নদী বয়ে গেছে। এ জন্য একটি সামগ্রিক অববাহিকাভিত্তিক পদ্ধতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।’ গবেষকদের এই সব গবেষণাপত্র নিয়ে আলোচনাই হয় কেবল, এসব নিয়ে কাজ হয় কমই। ফলে সমস্যা যেখানে ছিল সেখানেই থেকে যাচ্ছে। এখানে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে ভূ-রাজনীতি, মনে করা হচ্ছে এখানে আমরা পিছিয়ে আছি অনেকটাই।

এখন যেখানে আমরা সেখানে একটা বন্যার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এটা নিয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সতর্কতা দিয়েছে। এই সতর্কতা শুরুতে কৃষক পর্যায়ে ছিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল, বেরো ধান ৮০ শতাংশ পরিপক্ব হলেই যেন কাটা শুরু হয়। কৃষকেরা সে কাজটিই করেছেন। কৃষকের নিয়মিত কাজ শেষে এখন সরকার-প্রশাসনের দরকার বন্যা মোকাবেলা বিষয়ক প্রস্তুতি গ্রহণ করা। ভারতে বৃষ্টি কমলে দেশে বন্যা হবে না—স্রেফ প্রকৃতির ওপর নির্ভর না করে বন্যা হলে কী প্রক্রিয়ায় মানুষকে বাঁচানো যায় সে দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। হাতে আছে সময়, এই সময়টুকুর সঠিক ব্যবহার করাই হবে সময়ের কাজ।

;

শিল্প-সাহিত্যে সম্মাননা: ক্ষমতার আনুগত্যই ‘মানদণ্ড’ নয়



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বয়সে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের চেয়েও ৬ বছরের বড় ছিলেন ভাওয়ালের কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস। রাজ আনুকূল্য পরিত্যাগ করে রাজার বিরুদ্ধে কলম ধরার অপরাধে নির্বাসিত হয়েছিলেন কবি। ‘মগের মুলুক’ কাব্যগ্রন্থের জন্য নির্বাসিত গোবিন্দচন্দ্র দাসের জীবন কেটেছে নিদারুণ অর্থকষ্টে। বাংলা সাহিত্যকে ১০টি অমূল্য কাব্যগ্রন্থ উপহার দিলেও প্রতিভাধর এই কবির যাপিত জীবনের দুর্দশা ছিল প্রকট। শেষ জীবনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের মতো মহৎপ্রাণ কিছু মানুষেরা অসুস্থ কবিকে অর্থসহায়তা দিয়ে উদাসীন সমাজের খানিকটা প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন। দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে ওষ্ঠাগত কবি তাঁর কবিতায় জীবদ্দশায় স্বীকৃতি না পাওয়ার আক্ষেপ ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সমাজ-রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করে কবিতায় লিখেছিলেন, ‘আমি মরলে তোমরা আমার চিতায় দেবে মঠ?’

শিল্প-সাহিত্যের স্রষ্টাদের এই আক্ষেপ যুগে যুগে ধ্বনিত হয়ে আসছে। সবশেষ ঘটনাটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের গুণী শিল্পী সাদী মহম্মদের আত্মহনন। এসকল ঘটনা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে নীরবে চপেটাঘাত করে যায়। জীবদ্দশায় গুণীর কদর করতে বরাবরই ব্যর্থ আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র। বলা হয়ে থাকে যে সমাজে গুণীর কদর নেই, সেই সমাজে গুণীও জন্মায় না। সময়ের স্রোতে আমরা শ্রদ্ধায় নত হতে পারি, এমন গুণীজনদের ক্রমেই হারিয়ে ফেলছি। সেই শূন্যস্থান পূরণে আমাদের যোগ্য মানুষের অভাব প্রতিনিয়তই অনুভূত হচ্ছে।

ব্যক্তিত্ব ও মূল্যবোধের সঙ্গে আপস না করা মানুষের সংখ্যা দিনকে দিন কমে আসছে। বিপরীতে জায়গা করে নিচ্ছে স্তাবক ও অযোগ্য মানুষেরা। এতে করে সমাজে যে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে তা আমাদের ঐতিহ্যিক পরম্পরাকে বিপন্ন করে তুলছে। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ পদক ও পুরস্কার প্রদান নিয়ে মানুষের মনে যে নানা প্রশ্ন উঠতে দেখছি তা এই শূন্যতারই কার্যকারণ বলে মনে করেন বিজ্ঞজনরা। যেখানে নীরবে নিভৃতে বহু গুণীজন স্বীকৃতি না পাওয়ার বেদনা নিয়ে কাটান সেখানে পদক-পুরস্কার নিয়ে সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতা গুণীদের হতাশাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

এমন বাস্তবতার মাঝেই গত ৩০ এপ্রিল বাংলা একাডেমি ঘোষণা করল রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার-২০২৪। যে তিন গুণীকে এবার এই পুরস্কারে ভূষিত করা হচ্ছে তাঁদের রবীন্দ্র ও নজরুল সাধনা প্রশ্নাতীত। বাঙালি জাতির আত্মঅহংকারের প্রতীক এই দুই মহান কবির নামে প্রবর্তিত এ পুরস্কার নিয়ে এবার একাডেমি সংশ্লিষ্টরা তাদের বিচার-বিবেচনাকে প্রশ্নের উর্ধ্বে নিয়ে যেতে পেরেছেন, এটা আশাবাদের সঞ্চার করেছে।

বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। বহু গবেষণাগ্রন্থের লেখক ভীষ্মদেব চৌধুরীর রবীন্দ্র গবেষণায় উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে -দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫) ও প্রভাতসূর্য : রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা রবীন্দ্র অন্তঃপ্রাণ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকে তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতেও ভূমিকা রাখছেন।

বাঙালির হৃদয়স্পন্দন ও চেতনার বাতিঘর কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। নির্বাক কবিকে ঘিরে সেই সময়কার গবেষক ও সাহিত্যিকরা নানা দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং বিষয়-বৈচিত্রে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। কবির ঘনিষ্ঠজনরা তখনও জীবিত, রেফারেন্স গ্রন্থ হিসেবে যা কিছু প্রয়োজন-তাও দুর্লভ ছিল না। তথ্যগত প্রাপ্যতার সঙ্গে গভীর নিষ্ঠা ও ভক্তি নিয়ে অনেক শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক কবিকে নানাভাবে মূল্যায়নের প্রয়াস পেয়েছেন।

বাংলা সাহিত্যের দুই যশস্বী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ও ড. রাজিয়া সুলতানা দম্পতি আত্মনিয়োগ করেন নজরুল গবেষণায়। নজরুল গবেষণায় এই গুণী দুই গবেষকের গ্রন্থসংখ্যা বিপুল না হলেও কবিকে নিয়ে যে কয়েকটি গবেষণাগ্রন্থ তাঁরা রচনা করেন তা এদেশে নজরুলচর্চায় বিশেষ ভাবে ভূমিকা রাখে। সে কারণে তাঁরা পথিকৃৎ গবেষক হিসেবেও নন্দিত হন।

মোহাম্মদ আবদুল কাইউম নজরুল গবেষণায় উপহার দেন ‘নানা প্রসঙ্গে নজরুল’ ও ‘নজরুল সংবর্ধনা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ। অন্যদিকে রাজিয়া সুলতানার গবেষণা গ্রন্থ ‘কথাশিল্পী নজরুল’ ও ‘নজরুল-অন্বেষা’। প্রকাশিত এসব গ্রন্থসম্ভারের বাইরে এই দুই নজরুল গবেষক তাদের দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে নিষ্ঠার সঙ্গে অসংখ্য নজরুল গবেষক ও অনুরাগী সৃষ্টি করেছেন; যাঁরা পরবর্তী জীবনে বাংলাদেশে নজরুল চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ও ড. রাজিয়া সুলতানা-দু’জনই কবি নজরুল ইনস্টিটিউট প্রবর্তিত ‘নজরুল পুরস্কার’ লাভ করেছেন। ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ১৯৯১ সালে লাভ করেছিলেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।

২০২০ সালের ১২ জুন প্রয়াত হন ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম। স্বামী মৃত্যুর পর ড. রাজিয়া সুলতানা প্রবাসেই কাটাচ্ছেন সন্তানদের সঙ্গে। গেল ৩০ এপ্রিল ২০২৪ বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র ও নজরুল গবেষণায় ৩ জনকে একাডেমি পুরস্কারের জন্য নাম ঘোষণা করে। নজরুল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন ড. রাজিয়া সুলতানা।

স্বজনদের থেকে জানা গেছে, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়াসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় আক্রান্ত ড. রাজিয়া সুলতানা। পুরস্কারপ্রাপ্তির খবর জেনেছেন দূরপ্রবাসে বসে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি নাকি এই খবরে ভীষণ আনন্দিত! তাঁর চোখেমুখে পরিতৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, জানিয়েছেন তাঁর মেয়েরা। এই খবর জেনে আমরা নিশ্চয়ই আনন্দিত এজন্য যে, একজন গুণী গবেষক জীবন-সায়াহ্নে হলেও তাঁর গবেষণার জন্য রাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কৃত হতে যাচ্ছেন। বাংলা একাডেমির সংশ্লিষ্টরা এজন্য অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারেন। কিন্তু আমরা এও প্রত্যাশা করি যে, একজন গুণী গবেষককে তাঁর গবেষণার স্বীকৃতি পেতে বার্ধক্য পর্যন্ত কেন অপেক্ষায় থাকতে হবে? একটি পুরস্কারকে উদযাপন করার মতো শারীরিক ও মানসিক স্ফূর্তি থাকতেই কেন আমরা তাদের পুরস্কৃত করতে ব্যর্থ হচ্ছি-সেই প্রশ্নও আজ বড় হয়ে ধরা দিচ্ছে।

আমরা জানি, কোন স্বীকৃতির আকাঙ্খা ব্যতিরেকেই এখনও বহু গুণীজন নিভৃতে তাদের জ্ঞান ও শিল্পসাধনায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। কিন্তু অযোগ্যদের সম্মানিত করে রাষ্ট্র যখন নিজেই অসম্মানিত হয় তখন অনেকের মতো সেইসব গুণীজনরাও নিশ্চয়ই ব্যথিত হন। এবং এই বেদনার ভার সইতে না পেরে সাদী মহম্মদের মতো প্রতিথযশা সাধকশিল্পীকেও নীরব অভিমানে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে যাঁরা চালনা করেন তাদের মনে রাখা উচিত, পুরস্কারের মনোনয়নে কেবলমাত্র ক্ষমতার আনুগত্যই একমাত্র মানদণ্ড নয়।

লেখনির মুখে সত্য উচ্চারণে যে লেখকগণ নিঃশঙ্কচিত্ত হতে পেরেছেন ইতিহাসে তাদেরই ঠাঁই হয়েছে। রাজ আনুকূল্যে ব্রিটিশ শাসনামলে পূর্ববর্তী শাসকদের যে ইতিহাস রচিত হয়েছিল সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তবাতবায়ী হাতে, সেই প্রামাণ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন’ পরবর্তী যুগে একটি ফরমায়েশি গ্রন্থরূপে সকলের কাছে প্রমাণিত হয়েছে। ইতিহাসের নির্মোহ মূল্যায়নে সেই তথাকথিত ঐতিহাসিক স্বীয় মর্যাদাকে ধরে রাখতে পারেননি। আমরা যদি এই ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে স্মরণ করে সমকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকে সমুন্নত রাখতে পারি, প্রকৃত গুণীদের যথাসময়ে মান দিতে পারি, তবেই দেশে অনেক জ্ঞানীর জন্ম হবে এবং আমরা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথে এগিয়ে যেতে পারব। কবি গোবিন্দ দাসের মতো ‘মৃত্যুর পর চিতায় মঠ দেওয়া’ সমাজের চরিত্রকে বদলাতে পারব।

;